মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: সম্প্রতি, ইজরায়েলের গুরুত্বপূর্ণ হাইফা বন্দর (Haifa Port) কিনেছে ভারতের আদানি গোষ্ঠী (Adani Group)। কিন্তু, ভারতের সঙ্গে এই ঐতিহাসিক বন্দরের সম্পর্ক আজকের নয়। তা জানতে হলে ফিরে যেতে হবে ১০০ বছর আগে— যখন অটোমান এবং জার্মানদের হাত থেকে এই বন্দর উদ্ধার করেছিল ভারতীয় ঘোড়সওয়ার সেনা। ইতিহাসের সরণী বেয়ে ফিরে দেখা যাক সেই ঘটনা—
সময়টা ১৯১৮। আজ থেকে ১০০ বছরেরও বেশি আগে। ২৩ সেপ্টেম্বর শুধুমাত্র বল্লম সম্বল করে ভারতীয় ঘোড়সওয়ার সেনারা (Cavalry) মেশিনগানধারী জার্মান-অটোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে মুক্ত করেছিল ইজরায়েলের (Israel) হাইফা শহরকে। এই ঘটনা বদলে দেয় সেনার ইতিহাস। এই ঘটনার দুমাস পরেই শেষ হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধে। পৃথিবী এমনভাবে বদলে যায়, যার কল্পনা কেউ কোনওদিন করেনি। ভারতীয়রা ইজরায়েলে আজ কেন এত সমাদৃত, তা বুঝতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে আজ থেকে ১০০ বছর পিছনে।
আরও পড়ুন: বিক্রি হয়ে গেল ইজরায়েলের প্রধান বন্দর হাইফা, বর্তমান মালিক আদানি
প্রেক্ষাপট
ইজরায়েলের হাইফা শহর তখন জার্মান এবং তুর্কিদের দখলে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের উত্তেজনা তখন মধ্যগগনে। বিশ্বের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বন্দরগুলিকে তখন দখলের চেষ্টায় রয়েছে অ্যালাইড ফোর্স বা মিত্র সেনা এবং সেন্ট্রাল পাওয়ারের দেশগুলি। কারণ বন্দরগুলিকে দখল করতে পারলে শহর দখল করা সহজ হয়। পক্ষান্তরে যুদ্ধ জেতা সহজ হত। হাইফা তৎকালীন সময়ে বাণিজ্য ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বন্দর ছিল।
মিত্র বাহিনীর অন্তর্গত ফ্রান্স, গ্রেট ব্রিটেন এবং রাশিয়ার নজরে ছিল হাইফা, নাজারেথ এবং দামাস্কাস। এই হাইফা এবং নাজারেথ বর্তমান ইজরায়েলের অংশ। দামাস্কাস বর্তমান সিরিয়ার রাজধানী। জার্মান- অটোমানদের থেকে এই হাইফা বন্দর ছিনিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব পড়ে তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনের অধীনস্থ ফিফটিনথ ক্যাভালরি ব্রিগেডের ওপরে।
হায়দ্রাবাদ, মাইসোর, পাটিয়ালা, আলওয়ার এবং যোধপুর থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ইম্পেরিয়াল সার্ভিস ট্রুপের অন্তর্গত এই বল্লমধারী ঘোড়সওয়ার সেনাদের। ভারতীয় বল্লমধারী সেনাদের নিয়ে গঠিত এই ঘোড়সওয়ার সেনাবাহিনীকে হাইফা বন্দর আক্রমণের নির্দেশ দেয় ইংরেজ সরকার। কারণ তখন ইংরেজ সৈনিকরা অন্যত্র পাহারায় ব্যস্ত ছিল।
কিন্তু এ ছিল এক অসম্ভব এবং অসম যুদ্ধ। কারণ হাইফা শহরের একটু আগেই কারমেল পর্বতে, যুদ্ধের জন্যে সুবিধাজনক উঁচু স্থানে পাহাড়ায় ছিল জার্মান, অস্ট্রিয়ান এবং অটোমান সেনারা। তাদের হাতে ছিল উন্নত আর্টিলারিগান, মেশিনগান। আর ভারতীয় সেনাদের ভরসা শুধুই বল্লম। ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে পাহাড় চড়াও প্রায় এক অসম্ভব কাজ। যেন এক 'সুইসাইডাল মিশন'। কিন্তু সেদিন এই অসম্ভবকেই সম্ভব করেছিল ভারতীয় সেনা।
যুদ্ধ
ভারতীয় সেনারা জানতে পারেন, অটোমানরা পাহাড়ের ঢালু অংশের দিকে সবথেকে বেশি মাশিগানধারী সেনা মোতায়েন করেছে। কামান নিয়ে সেনারা পাহাড়ের চার জায়গায় ছড়িয়ে রয়েছে। মাইসোর ল্যান্সারদের ওপর মেশিনগানধারী সেনাদের পূর্ব দিক থেকে আক্রমণ করার দায়িত্ব পরে। যাতে তারা মেশনগানের আগুনের হাত থেকে যোধপুর ল্যান্সারদের (Lancer) সুরক্ষিত রাখতে পারে এবং তারা (যোধপুর ল্যান্সার) যাতে উত্তরদিক থেকে আক্রমণ করে কারমেল পাহাড় এবং হাইফা শহর সহজেই দখল করতে পারে।
২৩ সেপ্টেম্বর বিকেলে সেইমতো মাইসোর ল্যান্সাররা পাহাড়ের নীচের ভাগে আক্রমণ চালায়। আর যোধপুর ল্যান্সাররা আক্রমণ চালায় পাহাড়ের মূল অংশে জার্মান সেনাদের ওপরে। অবরোধ করা হয় রাস্তা। মেশিনগান এবং আর্টিলারির সামনে পড়ে যায় যোধপুর ল্যান্সাররা। নদীর চোরাবালিতে বাধাপ্রাপ্ত হয় তারা। কিন্তু এত বাধার পরেও হাইফা শহরে উপস্থিত হয় যোধপুর ল্যান্সাররা। তাদের পেছনেই শহরে ঢোকে মাইসোর ল্যান্সাররা। মেশিনগান, বুলেট কিছুই দমাতে পারেনি এই ভারতীয় বীরদের। ভয়ঙ্করভাবে আহত হওয়ার পরেও লড়াইয়ের ময়দান ছাড়েনি ভারতীয় সেনা।
ঘোড়সওয়ারদের এই দুই রেজিমেন্ট যৌথভাবে ২ জার্মান অফিসার এবং ৩৫ অটোমান অফিসারসহ ১৩৫০ জার্মান এবং অটোমানকে বন্দি বানায়। এছাড়াও ১৭টি আর্টিলারি গান, আটটি ৭৭ এমএম বন্দুক, চারটে ক্যামেল গান ও নেভাল গান এবং ১১টি মেশনগান বাজেয়াপ্ত করে। কিন্তু জয় কি বলিদান ছাড়া আসে! ভারতীয় সেনাদেরও এই জয়ের মূল্য চোকাতে হয়েছিল। যুদ্ধে ৮ জন ভারতীয় সেনার প্রাণ জ্যায়। আহত হয় ৩৪ জন।
ঘোড়সওয়ার সেনাবাহিনীর প্রধান মেজর দলপত সিং- প্রাণ হারান যুদ্ধে। তাঁর বীরত্বের পুরো ঘটনা ইজরায়েলের পাঠ্যপুস্তকে আজও পড়ানো হয়। 'হিরো অফ হাইফা'- র খেতাব দেওয়া হয় তাঁকে। এই যুদ্ধে হতবাক হয়েছিল গোটা বিশ্ব। কীভাবে কয়েক জন বল্লমধারী, ঘোড়সওয়ার সেনা সংখ্যায় বহুগুণ বেশি মেশনগানধারী সেনাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানিয়ে জল ছিনিয়ে নিয়ে এসেছিল!
যুদ্ধের তাৎপর্য
সেদিনের যুদ্ধ যে শুধু হাইফা দখলের জন্যই ছিল, তা নয়। ওই যুদ্ধের পর মনোবল ভেঙে গিয়েছিল তুর্কী এবং জার্মান সেনাদের। এছাড়াও ভারতীয় সেনাদের ওপর বিশ্বাস জন্মাতে শুরু করে ইংরেজ সরকারের। এরপর থেকে ভারতীয়দের দিয়ে সেনা বাহিনীর নেতৃত্ব দেওয়ানোও শুরু করে ব্রিটিশ সরকার। এরপরেই ১৯২২ সালে দ্য প্রিন্স অফ ওয়েলস রয়্যাল ইন্ডিয়ান মিলিটারি কলেজের প্রতিষ্ঠা হয়।
৬১তম ঘোড়সওয়ার রেজিমেন্টের প্রতিষ্ঠা
স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে একটি নতুন ঘোড়সওয়ার রেজিমেন্ট তৈরির কথা ভাবা হয়। মাইসোর এবং যোধপুর ল্যান্স্যারদের স্মরণে ১৯৫২ সালে জয়পুরে ৬১তম ঘোড়সওয়ার রেজিমেন্ট গঠন করা হয়। এটাই পৃথিবীর সর্বশেষ ঘোড়সওয়ার বাহিনী। পদ্মশ্রী, অর্জুন পুরষ্কার ছাড়াও একাধিক সম্মান পেয়েছে ভারতের এই ঘোড়সওয়ার বাহিনী।
হাইফা যুদ্ধে নিহত ভারতের বীর সেনাদের স্মৃতিতে দিল্লির তিন মূর্তি চকে একটি স্মৃতি সৌধ বানিয়েছে ভারত সরকার। ২০১৮ সালে ওই জায়গার নতুন নাম দেওয়া হয়েছে 'হাইফা চক'।
+ There are no comments
Add yours