Rani Bhavashankari: হুগলির রাণী ভবশঙ্করীকে কেন ডাকা হতো “রায়বাঘিনী” নামে? জানুন তাঁর বীরত্বগাথা

হিন্দু ধর্ম তথা শাস্ত্রে তাঁর ছিল বিশেষ আগ্রহ
raibhaghini
raibhaghini

মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: ষোড়শ শতকের এক বাঙালি রাণী যাঁর শৌর্য এবং বীরত্বের সামনে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন পাঠান সেনাপতি ওসমান খান। মাতা চণ্ডীর উপাসক রাণী ভবশঙ্করী (Rani Bhavashankari) অস্ত্র চালনা, ঘোড়ায় চড়া, রাজনীতিশাস্ত্রে অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন বলে জানা যায়। হিন্দু ধর্ম তথা শাস্ত্রে তাঁর ছিল বিশেষ আগ্রহ।

ভূরশুট রাজ‍্যের রাণী ভবশঙ্করী (Rani Bhavashankari)

ভূরশুট রাজ‍্যের রাণী ভবশঙ্করী (Rani Bhavashankari)। পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান হাওড়া, হুগলি, অবিভক্ত মেদিনীপুর এবং অবিভক্ত বর্ধমানের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে গড়ে উঠেছিল ভূরশুট রাজ‍্য। এই রাজ্যের সম্রাজ্ঞী ছিলেন ভবশঙ্করী। গবেষকরা বলছেন “ভূরিশ্রেষ্ঠ” থেকে এসেছে ভূরশুট নাম। এলাকাটি একসময় নাম ছিল ভূরিশ্রেষ্ঠ নগর। শ্রেষ্ঠ বণিকরা এই নগরে বাস করতো বলেই নাম হয় ভূরিশ্রেষ্ঠ। তাঁর জন্মসাল সম্পর্কে বিশেষ কিছু তথ্য না পাওয়া গেলেও জানা যায় ভবশঙ্করী (Rani Bhavashankari) ছিলেন ব্রাহ্মণ কন‍্যা। পিতা দীননাথ চৌধুরী ছিলেন পেঁড়োর জমিদারের অধীনস্থ পেঁড়ো দুর্গের সেনাপতি। বেশ লম্বা-চওড়া চেহারার মানুষ ছিলেন দীননাথ। রণকৌশলে ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ। ভূরিশ্রেষ্ঠ নগরের গণ‍্যমান‍্য ব‍্যক্তিদের মধ্যে একজন ছিলেন তিনি।

বাল্যকাল

এই পেঁড়োতেই জন্ম হয় ভবশঙ্করীর (Rani Bhavashankari)। পিতার দুই সন্তানের মধ্যে বড় ছিলেন ভবশঙ্করী। ছোট ভাইয়ের জন্মের সময় মৃত্যু হয় তাঁর মায়ের। শৈশব ও বাল্যকালে ভবশঙ্করী পিতার কাছে থেকে অস্ত্রবিদ‍্যা, ঘোড়ায় চড়া ও তীরন্দাজিতে দক্ষ হয়ে ওঠেন। এরপর কূটনীতি, রাজনীতি, সমাজতত্ত্ব ও দর্শনের পাঠ নেন।

রাজা রুদ্রনারায়ণের সঙ্গে বিবাহ 

কথিত আছে একদিন যুবতী ভবশঙ্করী (Rani Bhavashankari) দামোদর ও রণ নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে শিকারে যান। হঠাৎই হরিণকে তাড়া করার সময় একটি বুনো বাইসন আক্রমণ করে তাঁকে। ভবশঙ্করী এক হাতেই মেরে ফেলতে সক্ষম হন বাইসনটিকে। লোককথা অনুযায়ী, ওই সময় ভূরিশ্রেষ্ঠরাজ রুদ্রনারায়ণ নৌকোয় চেপে দামোদর বেয়ে কাষ্ঠসাংড়ার দিকে যাচ্ছিলেন। এই ঘটনা দেখে রীতিমতো অবাক হলেন তিনি। এই মেয়েকেই তিনি বিয়ে করবেন বলে মনস্থির করলেন। সেইমতো ভূরিশ্রেষ্ঠ নগরের রাজপুরোহিত হরিদেব ভট্টাচার্যের পৌরোহিত‍্যে ভবশঙ্করীর সঙ্গে বিবাহ সম্পন্ন হয় রাজা রুদ্রনারায়ণের।

দেবী চণ্ডীর স্বপ্নাদেশ

বিয়ের পর দামোদরের তীরে গড়-ভবানীপুরের পাশেই তৈরি করা হয় নতুন রাজবাড়ি। ভূরিশ্রেষ্ঠ রাজবংশের কুলদেবী ছিলেন রাজবল্লভী। জানা যায়, মাতা চণ্ডীর একটি রূপ দেবী রাজবল্লভীর নাম থেকেই ভূরিশ্রেষ্ঠ রাজ‍্যের পুরোনো রাজধানী “রাজবলহাট -এর নামকরণ হয়। ধার্মিক রাণী, দেবী রাজবল্লভীর অষ্টধাতুর মূর্তি তৈরি করান। মায়ের কাছে মানত করে তিনদিন উপবাস থাকার পর রাণী ভবশঙ্করী (Rani Bhavashankari) গড়-ভবানীপুরের একটি পুকুরে স্নান করতে যান। কথিত আছে, সে সময়ই তিনি জল থেকে লাভ করেন মায়ের স্বপ্নাদিষ্ট তরবারি। এই তরবারি হাতে থাকলে কোথাও তিনি পরাস্ত হবেন না, এই ছিল দেবী রাজবল্লভীর বর। সত্য বা বিশ্বাস যাই হোক, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রাণী ভবশঙ্করী (Rani Bhavashankari) ছিলেন অপরাজিতা।

ভুরশূট রাজ্যের সম্রাজ্ঞী

পরবর্তীকালে ভবশঙ্করী (Rani Bhavashankari) জন্ম দেন রাজকুমার প্রতাপনারায়ণের। রাজপুত্রের বয়স যখন পাঁচ বছর, তখন রাজা রুদ্রনারায়ণ পরলোকগত হন। রাজ‍্য পরিচালনার ভার তখন রাণীর ওপর। জানা যায়, স্বামীর মৃত্যুর পর তিন মাস ব্রহ্মচারিণী হয়ে ছিলেন রাণী ভবশঙ্করী। কাষ্ঠসাংড়ার শিবমন্দিরে রাণী ভবশঙ্করী (Rani Bhavashankari) শৈব সাধনায় নিয়োজিত করেছিলেন নিজেকে। আধ্যাত্মিক জীবনের পাশাপাশি রাণী ভবশঙ্করী রাজ‍্যের সামরিক ব‍্যবস্থাকেও ঢেলে সাজানো শুরু করেন এই সময়। তাঁর সময়ে শৌর্যে-বীর্যে, কৃষি, বাণিজ্য, তাঁত শিল্প ও ধাতু শিল্পে সমৃদ্ধ হয়ে উঠতে শুরু করে ভূরশুট রাজ‍্য। এককথায় রাজ্যে তখন স্বর্ণযুগ।

প্রধান সেনাপতির বিশ্বাসঘাতকতা

এদিকে আধিপত্য কায়েম নিয়ে বাংলায় তখন চলছে মোঘল-পাঠান দ্বন্দ্ব। মোঘলদের তাড়া খেয়ে পাঠানরা তখন আশ্রয় নিতে বাধ্য হয় ওড়িশায়। সেখান থেকে ফের বাংলায় আধিপত্য বিস্তারে সচেষ্ট হন পাঠান সর্দার ওসমান খান। জানা যায়, রাণী ভবশঙ্করী (Rani Bhavashankari) বাংলার মোগল-পাঠান দ্বন্দ্বে নিজেকে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ রেখেছিলেন। কিন্তু পাঠান সেনাপতি মোঘলদের বিরুদ্ধে রাণী ভবশঙ্করীর সাহায্য চাইলে তিনি তা নাকচ করে দেন। এতেই ক্রুদ্ধ হয় পাঠানরা। রাণীর দেওয়ান ছিলেন দুর্লভ দত্ত, প্রধান সেনাপতি চতুর্ভূজ চক্রবর্তী। শুরু হয় অন্তর্ঘাত, বিশ্বাসঘাতকতা করেন প্রধান সেনাপতি চতুর্ভূজ চক্রবর্তী। তিনি গোপনে হাত মেলান পাঠান সর্দার ওসমান খানের সঙ্গে। হিসাব খুব পরিষ্কার। যেকোনও মূল্যে ভূরশুটের রাজা হতেই হবে চতুর্ভুজকে।

ওসমান খান হত্যা

 গবেষকদের মতে, পাণ্ডুয়ার কাছে গড়-ভবানীপুর ছিল ভূরশুটের তদানীন্তন রাজধানী। সেখান থেকে ১৪ মাইল দূরে বাসডিঙা গড়ের কালীমন্দিরে একদিন সন্ধ্যায় পুজো দিতে যান রাণী ভবশঙ্করী (Rani Bhavashankari)। সুযোগ বুঝে দলবল নিয়ে পাঠান সর্দার ওসমান খান আক্রমণ করলেন রাণী ভবশঙ্করীকে (Rani Bhavashankari)। মুষ্টিমেয় কয়েকজন মাত্র দেহরক্ষী সেদিন রাণীর সঙ্গে ছিল। তাদের নিয়েই পাল্টা আক্রমণ শানান বীর রাণী। রাতের অন্ধকারে দু’ পক্ষের মধ্যে শুরু হয় তুমুল সংঘর্ষ। রাণী ভবশঙ্করীর হাতে ছিল দেবী রাজবল্লভীর স্বপ্নাদিষ্ট তরবারি। চরম পর্যায়ের লড়াইয়ে পরাজিত ও নিহত হলেন পাঠান সর্দার ওসমান খান। পরের দিন সকালে রাজধানীতে ফিরে রাণী প্রধান সেনাপতি হিসেবে রাজা ভূপতিকৃষ্ণ রায়কে মনোনীত করেন।

রায়বাঘিনী উপাধি

তৎকালীন মোগল সম্রাট আকবর, এই ঘটনা জানতে পেরে তাঁর সেনাপতি মানসিংহকে পাঠান রাণী ভবশঙ্করীর (Rani Bhavashankari) কাছে। দু’ পক্ষের মধ্যে হয় বন্ধুত্বপূর্ণ চুক্তি। ঠিক হয়, কেউ কারও রাজ‍্য আক্রমণ করবে না। ঐতিহাসিকদের মতে, এই সময়ই সম্রাট আকবর বীরাঙ্গনা রাণী ভবশঙ্করীকে “রায়বাঘিনী” উপাধিতে ভূষিত করেন। হাওড়া ও হুগলি জেলার বেশ কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে তিনি দূর্গ নির্মাণও করেন। শেষ বয়সে পুত্র প্রতাপনারায়ণের হাতে রাজপাট ছেড়ে দিয়ে কাশীবাসী হয়েছিলেন রায়বাঘিনী রাণী ভবশঙ্করী। তাঁর স্মৃতিতে ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে সরকারি উদ্যোগে প্রতি বছর হাওড়ার উদয়নারায়ণপুরে অনুষ্ঠিত হয় “রায়বাঘিনী ভবশঙ্করী” মেলা।


দেশের খবর, দশের খবর, সব খবর, সবার আগে পেতে ফলো করুন আমাদের FacebookTwitter এবং Google News পেজ।

Share:

Facebook
Twitter
WhatsApp
LinkedIn

You may also like

+ There are no comments

Add yours

Recent Articles