সুশান্ত দাস
চাঁদের চারদিকে ঘুরতে ঘুরতে ‘চন্দ্রযান ৩’ (Chandrayaan 3) নিজের গতি ও কক্ষপথের পরিধি দুই-ই কমিয়ে ফেলছে। রবিবার রাত ১১টা নাগাদ প্রথম কক্ষপথ বদল করেছে ‘চন্দ্রযান ৩’। এইভাবে আরও চারবার এই একই প্রক্রিয়া চালানো হবে। যার শেষে চাঁদ থেকে মাত্র ১০০ কিলোমিটার উচ্চতায় থাকবে ভারতের মহাকাশযান (ISRO Moon Mission)। সেখান থেকে শুরু হবে চূড়ান্ত অবরতণের প্রক্রিয়া।
পেরিজি ও অ্যাপোজি ঠিক কী?
কিন্তু, কীভাবে গতি কমানোর প্রক্রিয়া সম্ভব হচ্ছে? তা বোঝার আগে দেখে দেখে নেওয়া যাক উৎক্ষেপণের পর টানা ১৮ দিন ধরে পৃথিবীর চারদিকে ঘুরতে ঘুরতে ঠিক কীভাবে নিজের কক্ষপথ ও গতি বাড়িয়েছিল মহাকাশযানটি (ISRO Moon Mission)। তাহলেই সহজ হবে গোটা বিষয়টি। ১৪ তারিখ উৎক্ষেপণের সময় চন্দ্রযান মডিউলকে পৃথিবীর থেকে ১৭০ কিলোমিটার (পেরিজি) x ৩৬ হাজার কিলোমিটার (অ্যাপোজি) পরিধির ডিম্বাকৃতি কক্ষপথে স্থাপন করে এলভিএম-৩ রকেট। আগে দেখে নেওয়া যাক, পেরিজি ও অ্যাপোজি ঠিক কী? যেমনটা বলা হয়েছে, কক্ষপথের আকার ডিম্বাকৃতি। অর্থাৎ, একটি চন্দ্রযান পৃথিবীর চারপাশে এমন একটি কক্ষপথে ছিল, যার দূরত্ব (পৃথিবী থেকে) একটি জায়গায় ন্যূনতম এবং ঠিক তার উল্টোদিকে বৃহত্তম। এই ন্যূনতম দূরত্বের অবস্থানকে বলা হয় পেরিজি (অর্থ- পৃথিবীর কাছে)। অন্যদিকে দীর্ঘতম দূরত্বের পয়েন্টকে বলা হয় অ্যাপোজি (অর্থ- পৃথিবীর দূরে)।
গতি ও কক্ষপথ বদলের নেপথ্যে ‘পেরিজি ফায়ারিং’! সেটা কী?
এই ভাবে পৃথিবীর চারদিকে প্রদক্ষিণ করতে করেত কয়েক দিন অন্তর যখন ‘চন্দ্রযান ৩’ (Chandrayaan 3) ওই পেরিজি পয়েন্টে এসে পৌঁছত, তখন বেঙ্গালুরুতে স্থিত ইসরোর মিশন কন্ট্রোল (ISTRAC) থেকে ‘চন্দ্রযান ৩’ মডিউলে থাকা রকেটে সীমিত সময়ের জন্য ফায়ারিং করিয়ে তার কক্ষপথ বাড়িয়ে দেওয়া হতো। বিজ্ঞানের পরিভাষায় একে বলা হয় প্রথম আর্থ-বাউন্ড পেরিজি ফায়ারিং (Earth Bound Perigee Firing)। এটা সম্ভব হতো কারণ, ‘চন্দ্রযান ৩’-এর দিশা যে দিকে থাকত, ঠিক সেই দিকে তার মাথা থাকতো, আর রকেট ইঞ্জিন থাকতো লেজ বা পিছনের দিকে। রকেট ফায়ারিংয়ের ফলে, ‘চন্দ্রযান ৩’ মডিউলের গতি বেড়ে যেত। এক কথায় তাকে কিছুটা বাড়তি ধাক্কা দিয়ে গতি বৃদ্ধি করে দেওয়া হতো, যার ফলস্বরূপ, কক্ষপথের পরিধিও বেড়ে যেত।
পৃথিবীর বৃত্তে কেমন ছিল ‘চন্দ্রযান ৩’-এর কক্ষপথ বদল?
এই ফায়ারিং যেহেতু পেরিজিতে করা হতো, তাই পেরিজি-দূরত্বে খুব একটা হের-ফের না হলেও অ্যাপোজি-দূরত্ব অনেকটা বেড়ে যেত। যেমন, অরবিট রেইজিং ম্যানুভারের (Orbit Raising Maneuvre) ফলে ‘চন্দ্রযান ৩’-এর কক্ষপথের পরিধি বেড়ে হয়েছিল ১৭৩ কিমি x ৪১,৭৬২ কিমি। এর পর পর্যায়ক্রমে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ ম্যানুভারের পর ‘চন্দ্রযান ৩’ কক্ষপথের পরিধি হয় যথাক্রমে ২২৬ কিমি x ৪১,৬০৩ কিমি, ২২৮ কিমি x ৫১,৪০০ কিমি এবং ২৩৩ কিমি x ৭১,৩৫১ কিমি। শেষ তথা পঞ্চম ম্যানুভারে ‘চন্দ্রযান ৩’-এর (Chandrayaan 3) কক্ষপথের পরিধি বেড়ে হয়েছিল ২৩৬ কিমি x ১,২৭,৬০৯ কিমি। পাঁচবার চক্কর কাটার পর, প্রয়োজনীয় গতি জোগাড় করা ‘চন্দ্রযান ৩’-কে গত ১ অগাস্ট নিক্ষেপ করা হয় চন্দ্র-বৃত্তে। এর পর প্রায় পৌনে চার লক্ষ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে গত শনিবার চন্দ্র-কক্ষপথে প্রবেশ করে ‘চন্দ্রযান ৩’। চাঁদের মাধ্যাকর্ষণ শক্তির আওতায় চলে আসে ভারতের মহাকাশযান (ISRO Moon Mission)। এবার তখন থেকে শুরু হয় উল্টো পদ্ধতি— অর্থাৎ গতি ও কক্ষপথের পরিধি কমানোর পালা। কী করে তা সম্ভব হলো?
রিভার্স-গিয়ারে চাঁদের চারপাশে ঘুরছে ‘চন্দ্রযান ৩’! কীভাবে?
ইসরোর বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, চন্দ্র কক্ষপথে প্রবেশ করানোর সময় এমনভাবে রকেট ফায়ারিং করা হয়, যাতে দিশা এক থাকলেও, ‘চন্দ্রযান ৩’-এর মাথা ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যায়। অর্থাৎ, পৃথিবী থেকে চাঁদের দিকে এগনোর সময় ‘চন্দ্রযান ৩’-এর মাথা ছিল চন্দ্র-অভিমুখে। এবার মডিউলের মুখ বিপরীত দিকে থাকায় চাঁদের চারপাশে মহাকাশযান প্রদক্ষিণ করে চলেছে পিছন দিকে মুখ করে। এক কথায়, যেন ‘চন্দ্রযান ৩’ চাঁদের চারপাশে ঘুরে চলেছে ব্যাক বা রিভার্স-গিয়ারে। অর্থাৎ, ‘চন্দ্রযান ৩’-এর দিশা যেদিকে রয়েছে, সেদিকে রয়েছে রকেটের ইঞ্জিন। এবার লুনার পেরিজি ফায়ারিং বা পেরিলিউন ফায়ারিং-এর (Perilune Firing) মাধ্যমে সীমিত সময়ের জন্য রকেট চালানো হচ্ছে। এর ফলে, রকেট ব্যাক-থ্রাস্ট দিচ্ছে মহাকাশযানকে। অনেকটা ব্রেক কষার মতো। ফলস্বরূপ, এইভাবে বারে বারে ধাক্কা খেতে খেতে গতি ও পরিধি কমিয়ে নিচ্ছে ‘চন্দ্রযান ৩’ (Chandrayaan 3)। এক কথায়, আর্থ-বাউন্ড ম্যানুভারের ঠিক বিপরীত হচ্ছে মুন-বাউন্ড ম্যানুভার। কারণ, যে রকেট পৃথিবীর কক্ষে ‘চন্দ্রযান ৩’-এর গতি বাড়াতে সাহায্য করছিল, তা এখন উল্টোভাবে রেট্রো-রকেটের ভূমিকা পালন করে গতি কমাতে সাহায্য করছে।
দেশের খবর, দশের খবর, সব খবর, সবার আগে পেতে ফলো করুন আমাদের Facebook, Twitter এবং Google News পেজ।
+ There are no comments
Add yours