Rajbanshi People: উত্তরবঙ্গের রাজবংশী জনজাতি সত্যিই কি রাজবংশীয়?

"রাজবংশী" শব্দের আক্ষরিক অর্থ "রাজকীয় সম্প্রদায়"...
rajbanshi-1-new
rajbanshi-1-new

শুক্লা শিকদার

 

"রাজবংশী" শব্দের আক্ষরিক অর্থ "রাজকীয় সম্প্রদায়"। ব্যুৎপত্তিগতভাবে রাজবংশী বলতে বোঝায় রাজার বংশধরদের। 

প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, কোচ রাজবংশের উত্তরাধিকারদের একটি ধারা রাজবংশী জনজাতিগোষ্ঠীর সূচনা করেছে। কোচ উপজাতি থেকে উত্তরণ ঘটা কোচ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা রাজবংশী বা কোচ রাজবংশীদের একটি সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং নিজস্ব ভাষা রয়েছে। রাজবংশীদের নিজস্ব ভাষা তাদের পূর্বপুরুষ কোচ আদিবাসীদের ভাষার তুলনায় পৃথক। রাজবংশীদের নিজস্ব ভাষা কোচ ভাষার মতো "অবশ্যই বিপন্ন" (Definitely Endangered) ভাষাও নয়, বরং রাজকীয় ভাষা হিসেবে জনপ্রিয়। 

প্রাচীন কোচ উপজাতি থেকে উত্তরিত এই রাজবংশী জনজাতির জন্মভূমি ও বাসস্থানের মধ্যে রয়েছে তিব্বত, নেপাল, ভুটান, পশ্চিমবঙ্গের উত্তর অংশ, বিহার, অসম, অরুণাচল প্রদেশ, মেঘালয়সহ ভারতের উত্তর-পূর্বের বিভিন্ন অংশ এবং ভারতের আত্মজ প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের উত্তর অংশের রংপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ প্রভৃতি অঞ্চল। বর্তমানেও উক্ত বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে রাজবংশীরা এবং তাঁদের লোকতত্বাতিক ইতিহাস।

রাজবংশীরা যারা কোচদের সঙ্গে উত্পত্তিগতভাবে এক, যাদের কোচদের একই বর্ণের (caste) সদস্য হিসাবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছিল, তারা তাদের উন্নীত বংশমর্যাদার নিরিখে ১৯১০ সালে ক্ষত্রিয় রাজবংশী বলে নিজেদের নতুনভাবে সনাক্ত করতে আন্দোলনে নামল। কোচ রাজবংশের উত্তরাধিকারগণ ছাড়াও সামাজিকভাবে উচ্চ মর্যাদার অভিলাসী কোচরা এই আন্দোলনে সামিল হয়েছিল। কোচদের আদিবাসী পরিচয় ও অ-হিন্দু সংস্কৃতি থেকে পৃথক একটি নতুন পরিচয় আন্দোলনকারীরা দাবি করেছিল। 

পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহারের একজন রাজবংশী নেতা এবং সমাজ সংস্কারক ছিলেন পঞ্চানন বর্মা, যিনি ঠাকুর পঞ্চানন বা পঞ্চানন সরকার নামেও পরিচিতি লাভ করেছিলেন। একপর্যায়ে ক্ষত্রিয় রাজবংশী পরিচয়ের দাবিদার কোচদের মধ্যে আন্দোলন অনেকটা সংগঠিত হয় এবং পঞ্চানন বর্মার নেতৃত্বে তারা বর্তমান বাংলাদেশের রংপুরে ক্ষত্রিয় সমিতি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অর্থাৎ দীর্ঘকালীন সাংগঠনিক আন্দোলন ও সুসংহত নেতৃত্বের দ্বারা কোচদের একটি অংশ নিজেদের মূলগত আদিবাসী পরিচয় বর্জন করে নিজেদের ক্ষত্রিয় রাজবংশী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিল। মূলত সেই কারণেই একমাত্র মেঘালায় ছাড়া অন্য কোনও ভারতীয় রাজ্যে কোচ বংশোদ্ভূতগণ সাংবিধানিকভাবে তফশিলি উপজাতি হিসেবে নথিভুক্তি লাভ করেনি।

A Census report of Bengal, 1872 অনুযাযী কোচ উপজাতির মধ্যে তিনটি ভাগ— কোচ, রাজবংশী ও পোলিয়া। যে পোলিয়া জনজাতির অস্তিত্ব পশ্চিমবঙ্গের দিনাজপুরেও রয়েছে। W W Hunter কর্তৃক রচিত Statistical Account of Bengal, 1876 অনুযায়ী, কোচ থেকেই রাজবংশী জনজাতি উদ্ভুত হয়েছে। তাঁর মতে, রাজবংশীরা অর্ধ-হিন্দু ও আদিবাসী জনজাতিভুক্ত। 

নৃতত্ববিদ ভুবন মোহন দাসও (B M Das 1933-2008) তাঁর Among the people of North East India : the diary of an anthropologist,  রচনায় উত্তর-পূর্ব ভারতের আদিবাসী জনজীবনের উপর তাঁর ক্ষেত্রসমীক্ষা ভিত্তিক নিরীক্ষণের মাধ্যমে আলোকপাত করেছেন। দেহতাত্ত্বিক (Physical-anthropology) ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান (Social Cultural Anthropology) এর আলোকে তিনিও রাজবংশীদের কোচ থেকে উদ্ভুত বলে সনাক্ত করেছেন। মূলগত কোচ জনজাতির মধ্যে সংস্কৃত ও হিন্দুধর্মের প্রতি অনুরক্ত জনগোষ্ঠীরাই রাজবংশী বলে অনেকে মনে করেন। 

বিজ্ঞানী EDWARD GAILS- এর মতেও হিন্দু ধর্মের প্রতি অনুরক্ত কোচরাই রাজবংশী। রাজবংশী জনজাতির মধ্যে বিভিন্ন গোত্রের অস্তিত্ব রয়েছে। রয়েছে দোভাষীয়া রাজবংশী, মদেশী রাজবংশী। রয়েছে রায়বর্মন পদবি থেকে কোচ পদবি।

( লেখিকা নৃতত্ববিদ, মতামত লেখিকার ব্যক্তিগত )

Share:

Facebook
Twitter
WhatsApp
LinkedIn

You may also like

+ There are no comments

Add yours

Recent Articles