মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: সন্ধ্যার জলখাবার কিংবা যে কোনও সময় খিদে পেলে সিঙারার তুলনা হয় না। আর তার সঙ্গে যদি এক কাপ গরম চা হয়ে যায়, তাহলে তো কথাই নেই। কোথাও সিঙারা, আবার কোথাও সামোসা। ভারতে খুবই জনপ্রিয় পদ এটি, খেতেও জবরদস্ত! তাই আট থেকে আশি, সবারই পছন্দের খাবার এই সিঙারা। কিন্তু এর উৎপত্তি নিয়ে আছে অনেক বিতর্ক, আছে লম্বা এক ইতিহাস। সাধারণের মাথায় প্রশ্ন জাগতেই পারে, সামান্য একটি সিঙারার আবার কী ইতিহাস থাকতে পারে? হ্যাঁ, এর একটি ইতিহাস আছে, যা শুনলে অবাকই হবেন।
কীভাবে উৎপত্তি হল এই খাবারের?
সাধারণত আমরা গুগল সার্চ করলে দেখতে পাই, এই সিঙারা বা সামোসার উৎপত্তি বাংলাদেশে। এটি বাংলাদেশের খাবার বলেই বেশি পরিচিতি লাভ করেছে গোটা ইন্টারনেট জুড়ে। কিন্তু আসলে এর উৎপত্তি বাংলাদেশ বা ভারতবর্ষে নয়, উৎপত্তি ফরাসি শব্দ 'সংবোসাগ' থেকে। সেই 'সংবোসাগ'ই ভারতে হিন্দিভাষীদের কাছে সামোসা বা বাঙালিদের কাছে সিঙারা নামে পরিচিত। ইতিহাস থেকে জানা যায়, এই খাবারটির উৎপত্তি এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যেই। মধ্যপ্রাচ্যের তুর্কিদের কাছে একটি প্রিয় এবং মুখরোচক খাবার ছিল এই সামুচা বা সামোসা। পরে ভারতবর্ষে তুর্কি আগমনের পর এই খাবার এখানেও জনপ্রিয়তা পায়, গোটা ভারত জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এই খাবারটি।
বিখ্যাত পর্যটক, লেখকদের লেখায় এর উল্লেখ
ইরানি ঐতিহাসিক আবুল ফজল বেহাকির লেখা ‘তারিখ-এ-বেহাগি’ নামের বইয়ে এই সিঙারা বা সামোসার উল্লেখ পাওয়া যায়। যতদূর জানা গেছে, তখন সামোসাগুলি আকারে ছোট ছোট হত, যেগুলি তখন 'সাম্বোসা' নামে পরিচিত ছিল। সেই সময় মধ্যপ্রাচ্যের পর্যটক ও বণিকরা ঘোড়া বা উটের পিঠে নানা জায়গায় ভ্রমণ করত, আর খিদে পেলে তাদের ছোট ছোট ঝোলা থেকে বের করত এই সাম্বোসা। এগুলো আকারে ছোট হওয়ায় সহজে সব জায়গায় নিয়ে যাওয়া যেত ও যেখানে খুশি খাওয়া যেত।
দিল্লির সুলতানি যুগেও সিঙারার নাম পাওয়া যায়
আবার দিল্লির সুলতানি যুগেও এই খাবারটির চল ছিল বলে জানা যায়। তৎকালীন সুলতানি যুগের রাজকবি আমির খসরু, যিনি ভারতের তোতাপাখি নামে পরিচিত ছিলেন, তাঁর বই থেকে এই সিঙারার নাম পাওয়া যায়। যেখানে কোনও এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, 'রাজকুমারগণ, আভিজাত্যরা মাংস, পেঁয়াজ ও ঘি দিয়ে তৈরি সামোসা উপভোগ করতেন'। এছাড়াও জানা যায়, দিল্লির তদানীন্তন রাজা মহম্মদ বিন তুঘলকের খুব প্রিয় ছিল এই সামোসা। তখন তাঁর রাজদরবারে রয়্যাল স্ন্যাক্সেরও নাকি মর্যাদা পেত এই খাবার। মুঘল আমলেও জনপ্রিয় ছিল এই পদটি। আবুল ফজলের লেখা 'আইন-ই-আজবরি' গ্রন্থ থেকে 'সানবুসাহ ' নামক একটি খাবারের উল্লেখ পাওয়া যায়, যেটির ভিতরে মাংসের পুর থাকত এবং নামি দামি অনেক মশলাও ব্যবহার করা হত।
বাংলতেও প্রচলিত ইতিহাস আছে সিঙারার
মনে করা হয়, বাংলায় প্রথম সিঙ্গারার প্রচলন শুরু প্রায় ১৭০০ এর দশকে, নদিয়া জেলায় রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের হাত ধরে। এক সময় রাজ দরবারের রাঁধুনি গিরিধারী রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে খাবার হিসেবে লুচি দেন। কিন্তু রাজা কোনও এক বৈঠকে ব্যস্ত থাকায় লুচি ঠান্ডা হয়ে যায়। পরে গিরিধারীকে এই লুচি বদলে অন্য খাবার নিয়ে আসার অনুরোধ জানান। কিন্তু খাবার বদলে আনা হয় মিষ্টি, যা রাজার একদম পছন্দের জিনিস ছিল না। কারণ কৃষ্ণচন্দ্রের ছিল মধুমেহ। তাই রেগে গিয়ে রাজা গিরিধারীকে শূলে চড়ানোর আদেশ দেন। পরের দিন গিরিধারীর স্ত্রী ধরিত্রীদেবী কান্নায় ভেঙে পড়েন এবং রাজার কাছে আরেকটিবার সুযোগ চান। রাজা আদেশ দেন তাঁর জন্য কোনও গরম খাবার বানিয়ে আনতে। ধরিত্রীদেবী রান্নাঘরে গিয়ে বুঝতে পারছিলেন না, কী এমন খাবার বানানো যায়। তখন তিনি লুচি বানিয়ে তার মধ্যে আগে থেকে রান্না করে রাখা ঠান্ডা তরকারি মিশিয়ে পুর হিসেবে ব্যবহার করে গরম ঘিতে ভেজে নিলেন এবং সেটি রাজাকে দিলেন। রাজা খেয়ে অনেক খুশি হয়ে তার রাঁধুনি গিরিধারীকে ছেড়ে দিলেন এবং এই খাবার হয়ে উঠল জনপ্রিয়, যা বর্তমানে সিঙারা নামে পরিচিত।
অর্থাৎ বোঝাই যাচ্ছে, পাড়ার দোকানে পাওয়া সামান্য টাকার সিঙারার কত বড় ইতিহাস। যা একসময় রাজরাজাদের খাবার হিসাবেই পরিচিত ছিল। এটি আরবের দেশগুলোতে সানবাস্সাজ, আফগানিস্তানে সাম্বোসা, তুর্কিতে সাম্সা, পোর্তুগাল মোজাম্বিকে চেমুকা, পাকিস্তানে 'সমসা' ও আমাদের বাংলায় সিঙারা নামে আজও জনপ্রিয়।
দেশের খবর, দশের খবর, সব খবর, সবার আগে পেতে ফলো করুন আমাদের Facebook, Twitter এবং Google News পেজ।
+ There are no comments
Add yours