মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: দেবী বিপত্তারিণীর (Bipodtarini Puja) ব্রত আষাঢ় মাসে রথ (Rath Yatra) এবং উল্টোরথের মাঝে যে শনি এবং মঙ্গলবার পড়ে সেই দুই দিনেই পালিত হয়। কথিত আছে, এই ব্রত পালন করার সময় দেবীর চরণে উৎসর্গকৃত ‘লাল তাগা’ হাতে বাঁধা হলে বিপদ ধারকাছেও ঘেঁষতে পারবে না।
যিনি বিপদ তারণ করেন তিনিই বিপত্তারিণী
দেবী দুর্গা (Goddess Durga) হিন্দুধর্মের দেবী। দেবাদিদেব মহাদেবের (Lord Shiva) অর্ধাঙ্গিনী আদি শক্তি। অন্যান্য দেবী তাঁরই অবতার বা ভিন্ন রূপ। দেবী দুর্গার ১০৮ রূপের মধ্যে অন্যতম দেবী সঙ্কটনাশিনীর এক রূপ, দেবী বিপত্তারিণী (Bipodtarini Puja)। সঠিক অর্থে বিশ্লেষণ করলে ‘বিপত্তারিণী’ বা ‘বিপদনাশিনী’ দেবীর নাম নয়, উপাধি। যিনি বিপদ তারণ করেন, তিনিই বিপত্তারিণী। আসলে, মহামায়ার আলাদা করে কোনও নাম হয় কি? ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ ইনিই। আবার ‘দশমহাবিদ্যা’ও তাঁরই রূপের প্রকাশ।
স্বামী-সন্তান-পরিবারের মঙ্গল কামনায় বিপত্তারিণী
বাংলায় ঘরে ঘরে বিবাহিত মহিলারা স্বামী-সন্তান-পরিবারের মঙ্গল কামনায় মা বিপত্তারিণী (Bipodtarini Puja) পুজো করেন। গ্রামাঞ্চলে বিপত্তারিণী পুজো চারদিন ধরে চলে। প্রথম দিনে দেবীর আরাধনা করা হয়। মহিলারা গঙ্গা বা কোনও নদীতে স্নান করে দণ্ডী কাটেন। তারপর দুই রাত্রি ধরে রাতে বাংলা লোকগান, ভজন ও কীর্তন চলে। চতুর্থ দিনে বিসর্জন হয়। বিপত্তারিণী পুজো উপলক্ষে মেয়েরা উপবাস করেন। কিন্তু জানেন কি এই পুজোর মাহাত্ম্য? দেবীর মাহাত্ম্য নিয়ে একাধিক বৃত্তান্ত রয়েছে। দেবীর বিপত্তারিণী রূপ নিয়ে ‘মার্কণ্ডেয় পুরাণে’ কাহিনীটি বেশ জনপ্রিয়—
কথিত আছে, শুম্ভ-নিশুম্ভ, অসুর ভ্রাতৃদ্বয়ের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে দেবগণ একবার মহামায়ার স্তব করছেন, এমন সময় শিবজায়া পার্বতী সেখানে হাজির হয়ে শুধালেন, “তোমরা কার স্তব করছ গো?” যাঁর স্তব, তিনি স্বয়ংই এ প্রশ্ন করছেন। কিন্তু দেবতারা তাঁকে চিনতে পারলেন না। তখন পার্বতী নিজের স্বরূপ দেখিয়ে বললেন, “তোমরা আমারই স্তব করছ।” এর পরবর্তীতে দেবী শুম্ভ-নিশুম্ভকে বধ করেন। দেবতাদের বিপদ থেকে উদ্ধার করলেন। সেই থেকে বিপত্তারিণী পুজোর উৎস।
আরও পড়ুন: বিপদ এড়াতে বিপত্তারিণী পুজোয় ভুলেও করবেন না এই কাজগুলি
দেবীর মাহাত্ম্য নিয়ে একাধিক বৃত্তান্ত রয়েছে
এই পুজোর একটি কাহিনি রয়েছে। ব্রতকথা অনুযায়ী, বিষ্ণুপুরের মল্ল রাজবংশের এক রানির এক নিম্নবর্ণের সখী ছিলেন। তিনি জাতে মুচি। এই মহিলা নিয়মিত গোমাংস খেতেন। রানিও একদিন কৌতূহলী হয়ে গোমাংস খাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। প্রথমে তিনি নিমরাজি হন। পরে তিনি রানির আদেশ রক্ষার্থ গোমাংস আনেন। অন্তঃপুরে গোমাংস প্রবেশ করেছে— এই খবর রাজার কাছে পৌঁছে যায়। তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে রানিকে শাস্তি দিতে উদ্যত হন। রানি গোমাংস তাঁর বস্ত্রের আড়ালে লুকিয়ে রেখে বিপত্তারিণী মা দুর্গাকে স্মরণ করতে থাকেন। রানিকে তল্লাশি করে রাজা দেখতে পান তাঁর বস্ত্র আড়ালে গোমাংস নয়, রয়েছে একটি লাল জবা ফুল। লাল জবা কালী পুজোর অন্যতম উপকরণ। মায়ের এই পুষ্প দেখে রাজা তাঁর ভুল বুঝতে পারেন। রানিকে ক্ষমা করে দেন। মা বিপত্তারিণী দুর্গার কৃপায় রানির বিপদ কেটে গেল। এরপর থেকে রানি নিষ্ঠা-সহকারে বিপত্তারিণীর ব্রত করতে থাকলেন। সেই থেকেই বিপত্তরিণীর পুজো প্রচলিত হয়েছে বলে জানা গিয়েছে।
পুজোয় তেরো সংখ্যার তাৎপর্য
এই পুজোর একটা বিশেষ নিয়ম হল সবকিছু ১৩টা করে উৎসর্গ করতে হয় দেবীকে। ব্রতর আচার হিসেবে সব কিছু দিতে হয় তেরোটি করে। যেমন— তেরোটি নৈবেদ্য সাজাতে হয়। ব্রত পালনে লাগে তেরো রকম ফুল, তেরো রকম ফল, তেরোটি পান, তেরোটি সুপুরি, তেরোটি এলাচ। এছাড়া, বিপত্তারিণী ব্রতপালনের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হিসেবে হাতে বাঁধতে হয় লাল ডুরি বা ডোর বা তাগা। এই ডোর তৈরির ক্ষেত্রেও তেরো সংখ্যা গুরুত্বপূর্ণ। তেরো গাছা লাল সুতোর সঙ্গে তেরোটি দূর্বা রেখে তেরোটি গিঁট বেঁধে তৈরি হয় এই পবিত্র তাগা বা ডোর। বিশ্বাস করা হয় যে, এই তাগা হাতে পরলে তাঁকে কোনও বিপদ স্পর্শ করতে পরে না৷
বিপত্তারিণী (Bipodtarini Puja) পুজোর শেষে সকলেই হাতে ওই তাগা বেঁধে দেওয়া হয়৷ মেয়েরা বাম হাতে ও ছেলেরা ডান হাতে এটি পরেন৷ এটি শুধু ব্রত পালন যিনি করছেন তিনিই যে বাঁধেন তা নয়, পরিবারের অন্য সদস্যরাও বাঁধেন বিপন্মুক্তির জন্য৷ ব্রতপালনের পর খাবার যা খেতে হয়, সেখানেও ১৩ সংখ্যা রাখা আবশ্যক৷ মায়েরা প্রসাদ হিসেবে খান, তেরোটি লুচি বা পরটা সঙ্গে তেরো রকমের ফল। চাল-চিঁড়ে-মুড়ি এসব খাওয়া যায় না৷ ফল বা ময়দার রান্না যাই খাওয়া হোক না কেন সেটা ১৩ সংখ্যায় গ্রহণ করার কথাই ব্রতে বলা হয়৷ তবে যদি সেটা না হয় তাহলে পুজো মিটে যাওয়ার পর বিজোড় সংখ্যাতেও খাদ্যগ্রহণ করা যায়৷
দেশের খবর, দশের খবর, সব খবর, সবার আগে পেতে ফলো করুন আমাদের Facebook, Twitter এবং Google News পেজ।
+ There are no comments
Add yours